এই দুটিই জন্মগত ত্রুটির উদাহরণ। এমন বহু বহু জন্মগত ত্রুটির কথা জানি আমরা প্রতিনিয়ত। এমনি হাজারো ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারে একটি শিশু। জন্মগত ত্রুটি যত বড় ও জটিল, শিশুর বেঁচে থাকার সমস্যাও তত বেশি। অনেক ক্ষেত্রে সবার সব আনন্দকে বেদনায় বদলে দিয়ে জন্মের কয়েক ঘণ্টা অথবা কয়েক দিনের মধ্যেই শিশুর মৃত্যু হতে পারে।
জন্মগত ত্রুটি কী?
এটা হচ্ছে শিশুর জন্মের আগেই মাতৃগর্ভে থাকাকালীন ভ্রূণের ত্রুটি ও অস্বাভাবিকত্ব। সমস্যা যা হওয়ার, তা ঘটে যায় সবার চোখের আড়ালে গর্ভকালীন ভ্রূণের বেড়ে ওঠার সময়। একবিংশ শতাব্দীর এই উন্নত জীবনেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভ্রূণের এই অস্বাভাবিকত্ব বোঝা গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই কেউই তা বুঝতে পারে না।
অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের জন্মগত ত্রুটি ও রোগব্যাধি
গর্ভে লালিত স্বপ্নের শিশুর জন্ম সব মা-বাবা ও পরিবারের জন্য আনন্দের। এই আনন্দ আর স্বপ্ন কখনো কখনো ভেঙে পড়ে শিশুর জন্মগত ক্রটি ও রোগব্যাধিতে। কোনো ক্ষেত্রে তা সারা জীবনের জন্য অভিশাপ হয়ে থাকে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, ইউরোপ–আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও জন্মগত অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের ত্রুটি ও রোগব্যাধি নিয়ে জন্মায় শতকরা তিন থেকে চার ভাগ শিশু। আর অনুন্নত বিশ্বে এর মাত্রা আরও বেশি। এসব শিশুর চেহারা–আকৃতি সবকিছুই সারা জীবনের জন্য মা–বাবা ও সমাজের অন্য সবার দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ক্রোমোসোমজনিত অস্বাভাবিকত্ব
বংশানুক্রমে মানুষের যে জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, তা এগিয়ে নিয়ে যায় জিন। আর এই জিনের ধারক ও বাহক হচ্ছে ক্রোমোসোম। মা ও বাবার কাছ থেকে আসে ২৩টি করে ক্রোমোসোম। এই ক্রোমোসোমের ভেতর থাকে জিন, যার প্রভাবে শিশুর চেহারা, আকৃতি, বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। এই ক্রোমোসোমের সংখ্যা যদি কমবেশি হয় অর্থাৎ এটা কম বা বেশি হলেই ঘটে যায় বিপত্তি। হতে পারে ডাউন সিনড্রোম বা আরও অনেক অস্বাভাবিকত্ব।
গর্ভাবস্থায় অসুখ–বিসুখ
গর্ভকালীন মায়ের কিছু কিছু অসুস্থতাও নানা রকম অস্বাভাবিকত্ব আনে গর্ভের ভ্রূণের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গে। মেয়েদের চিকেন পক্স, রুবেলা ইত্যাদি ভাইরাল সংক্রমণ যদি প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় হয়, তবে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে শিশুর। তেমনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ মায়ের থাকলে বাচ্চার ত্রুটি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মায়ের অসুস্থতার কারণে ওষুধের ব্যবহারও খুব সাবধানতার সঙ্গে করতে হয়। কারণ কিছু কিছু ওষুধপত্র শিশুর জন্য মারাত্মক হুমকি। মা অ্যালকোহল ও ধূমপানে আসক্ত হলেও বিপদ হতে পারে।
জিনের অস্বাভাবিকত্ব
অনেক ক্ষেত্রে ক্রোমোসোম ঠিক থাকতে পারে কিন্তু এক বা একাধিক জিনের মধ্যে থাকতে পারে অস্বাভাবিকত্ব। ফলাফল মারাত্মক। বহু রোগব্যাধি হয় এই কারণে। যেমন সিসটিক ফাইব্রোসিস, হোমোফিলিয়া, সিভিল সেল এনিমিয়া এবং আরও বহু রোগব্যাধি এই জিনের অস্বাভাবিকত্বের ফল।
জেনেটিক, পারিপার্শ্বিক ও পরিবেশগত কারণ
এই দুটির মিলন নানা ক্ষেত্রে সমস্যা বৃদ্ধি করে। আমাদের পরিবেশের বিরূপ প্রভাব ও কেমিক্যাল পেস্টিসাইড এবং জেনেটিক সমস্যা একসঙ্গে মিলে শিশুর জন্মকে অস্বাভাবিক করে তোলে। এতে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।
অজানা কারণ
কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, এমন অনেক ত্রুটিও একেবারে কম নয়।
প্রতিকার কী?
অনেক রকম জন্মগত ত্রুটি মায়ের গর্ভকালীন উপযুক্ত পদক্ষেপ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা দিয়ে প্রতিকার করা সম্ভব। গর্ভবতী মায়ের এবং প্রসূতিকালীন সুষম খাবার, ভিটামিন, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি স্বাস্থ্যবান শিশুর জন্ম ও বেড়ে ওঠাকে সাহায্য করে। মায়ের জন্য অ্যালকোহল, ধূমপান ইত্যাদি অভ্যাস পরিত্যাগ করা অত্যন্ত জরুরি। মায়ের জন্য ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। গর্ভকালীন টিকা নেওয়া প্রয়োজন। আর এভাবেই অনেক রোগের প্রতিকার করে শিশুর জন্মত্রুটি এড়ানো যেতে পারে। গর্ভকালীন কিছু কিছু পরীক্ষা এবং আলট্রাসনোগ্রাম করে শিশুর অবস্থা ও কিছু কিছু রোগ নির্ণয় করা যায়। আর এ জন্য নিয়মিত প্রসূতির চেকআপের গুরুত্ব অনেক।
—ডা. কাজী মো. কামরুল হাসান
এমবিবিএস, ডিসিএইচ (শিশু স্বাস্থ্য)
নবজাতক ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ
কনসালটেন্ট, নিউনেটোলজি ও শিশুরোগ বিভাগ
চেম্বার: ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা।