শনিবার সন্ধ্যায় ভারতের রাজধানী দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরী এলাকায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ওই এলাকার অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের কাজ – এই মর্মে প্রচার শুরু করেছে বিজেপি ও তার সমর্থক বজরং দল, ভিএইচপি-র মতো সংগঠনগুলো। যদিও এমন দাবির কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কেউই হাজির করতে পারেনি।
বিভিন্ন আঞ্চলিক হিন্দি পত্রিকা ও হিন্দি টিভি চ্যানেলেও লাগাতার বলা শুরু হয়েছে, জাহাঙ্গীরপুরী আসলে ‘বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের আস্তানা’ এবং সেদিন তারাই সেখানে হামলার সূচনা করেছে।
দাঙ্গার সময় আহত হওয়া একজন পুলিশকর্মীকে উদ্ধৃত করেও বলা হচ্ছে, তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় হামলাকারীরা বাংলায় স্লোগান দিচ্ছে বলেও নাকি শুনেছিলেন।
বস্তুত জাহাঙ্গীরপুরীতে হিংসার দায় যেভাবে কথিত বাংলাদেশিদের ওপর চাপানো হচ্ছে, তা রীতিমতো পরিকল্পনামাফিক বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।
দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীতে হনুমান জয়ন্তীর শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ শুরু হয় শনিবার সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লিতে বিজেপির বিতর্কিত নেতা কপিল মিশ্রা একটি ভিডিও বার্তা টুইট করে বলেন – ওই এলাকাটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ডেরা বলে পরিচিত, আর তারাই সেখানে দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করেছে।
মি মিশ্রাকে সেখানে বলতে শোনা যায়, “জাহাঙ্গীরপুরীতে অবৈধ বাংলাদেশিরা থাকেন। দু’বছর আগে দিল্লির দাঙ্গাতেও তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে পুলিশের চার্জশিটে বলা হয়েছে।”
“শাহীনবাগের প্রতিবাদেও তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। এই অনুপ্রবেশকারী দাঙ্গাকারীদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে তাদের প্রত্যেকের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া উচিত”, বলেন তিনি।
কপিল মিশ্রা হলেন বিজেপির সেই নেতা, ২০২০র ফেব্রুয়ারিতে যার উসকানিমূলক বক্তৃতা উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল বলে অভিযোগ।
গত আটচল্লিশ ঘন্টায় কপিল মিশ্রার ওই ভিডিও বার্তা অজস্রবার রিটুইট বা ফরোয়ার্ড করা হয়েছে।
অনেক হিন্দি চ্যানেলে ও খবরের কাগজেও ইতিমধ্যে বলা শুরু হয়েছে, জাহাঙ্গীরপুরীর দাঙ্গা আসলে বাংলাদেশিদেরই কাজ। কেউ কেউ আবার এর সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলিমদের কথাও জুড়ে দিচ্ছেন।
যদিও ওই এলাকায় যে আসলেই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বা রোহিঙ্গারা থাকেন – এমন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কেউই হাজির করতে পারেনি।
জনপ্রিয় হিন্দি দৈনিক জাগরণে খবরের শিরোনাম করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশি ঘুসপেটিয়াদের (অনুপ্রবেশকারী) কব্জায় জাহাঙ্গীরপুরী’। তাদের খবরে আরও বলা হয়, ওই এলাকার বারোটি ব্লকের বেশির ভাগেই রোহিঙ্গারা থাকছেন এবং সে কারণে এলাকায় অপরাধের ঘটনাও বাড়ছে।
এর মধ্যে জল্পনা আরও ইন্ধন পেয়েছে দাঙ্গায় গুলিবিদ্ধ পুলিশ কর্মী মেধালাল মীনার বিবৃতিতে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই দিল্লি পুলিশের ওই সাব-ইনস্পেক্টর সাংবাদিকদের বলেন, “ভিড়ের মধ্যে তলোয়ার দোলাচ্ছিল একদল লোক, আমি বাংলাদেশি ভাষায়, মানে বাংলাতে কিছু স্লোগানবাজিও শুনেছিলাম।”
“ওই ভিড় থেকেই আমার ওপর গুলি চালানো হয়, এছাড়া আমার অনেক সহকর্মীও আহত হয়েছেন”, বলেন মেধালাল মীনা।
দিল্লি বিজেপির প্রধান আদেশ গুপ্তাও মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, ”রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশিদের আপনারা কি জামাই আদরে দিল্লিতে এনে বসাচ্ছেন?”
এদিকে স্থানীয় হিন্দু বাসিন্দারাও বার্তা সংস্থাকে ও চ্যানেলগুলোর সামনে বলছেন, জাহাঙ্গীরপুরী যে বাংলাদেশিদের ডেরা – এটা সবাই জানে।
ভিএইচ-পির একদল সমর্থক যেমন এদিন জাহাঙ্গীরপুরীর কৌশল চকে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, “এখানে একটা বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করলেও বলে দেবে পুরো এলাকাটায় বাংলাদেশিরাই থাকে।”
কেউ কেউ আবার বলছিলেন, “মূলত সি ব্লকে থাকা এই বাংলাদেশিরা চুরি-চামারি, দাঙ্গাহাঙ্গামা করে থাকে। রাস্তা দখল করে থাকলেও প্রশাসন এদের কিছুই করতে পারে না।”
নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে শাহীনবাগে প্রতিবাদের সময়ও এদের ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় কিছু বাসিন্দা।
রাকেশ চৌহান যেমন বলছিলেন, “এরা সবাই বাংলাদেশি মুসলিম – কারণ ভারতীয় মুসলিমরা একাজ করতেই পারে না।”
“শাহীনবাগের সময় দেখতাম রোজ দুটো বাস ভাড়া করে এদের মেয়ে-বউদের ওখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে ভারত হারলে এরা জাহাঙ্গীরপুরীতে ঢোল বাজিয়ে উৎসব করে, আমরা সবাই জানি।”
অন্যদিকে এলাকায় ব্যাপক পুলিশি অভিযান ও ধরপাকড়ের পর জাহাঙ্গীরপুরীর মুসলিমরা সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলতেই ভয় পাচ্ছেন।
তবে সোনু নামে একজন সন্দেহভাজন বন্দুকধারীর মা আশিয়া বেগম অবশ্য দাবি করেছেন, তারা মোটেই বাংলাদেশের লোক নন।
আশিয়া বেগম ভারতের একটি টিভি চ্যানেলকে বলেন, তারা কলকাতার কাছে মহিষাদল-হলদিয়া অঞ্চলের লোক, দিল্লিতে বহু বছর ধরে বাস করছেন।
“আমার ছেলেরা ছোটখাটো মুরগির ব্যবসা করে – দাঙ্গার সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্কই নেই” বলেন তিনি।
সোমবার বিকেলে বিজেপির কপিল মিশ্রা অবশ্য আশিয়া বেগমের এই ভিডিও সাক্ষাৎকারটিও টুইট করে আবার সেই একই দাবি করেন।
জাহাঙ্গীরপুরী এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে স্থানীয় বিজেপি নেতাদের এ অভিযোগ কয়েক বছর ধরেই চলছে। কিন্তু মুসলিমরা একথা অস্বীকার করে বলছেন, তারা দিল্লিতে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্য থেকে।
এদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের শ্রমিক বা বাতিল লোহালক্কড়ের জিনিস বিক্রি করেন।
“আপনি আমাদের দলিলপত্র চেক করে দেখতে পারেন” – বিবিসির সংবাদদাতাকে বলছিলেন সাজদা নামের এক বাসিন্দা। তার দুঃখ, মিডিয়ায় পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারের কারণে এখানে মুসলিমদের সাথে অপরাধীর মত আচরণ করা হচ্ছে।